বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর এবং বাংলাদেশে গ্রীণ ব্যাংকিং বিষয়ক নীতিমালার প্রবর্তক ড. আতিউর রহমান বাংলাদেশে কৃষি বিশেষজ্ঞ ও কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ে কাজ করা একটা সংগঠন ‘A green: Aim for a Green Bangladesh’ এর লাইভ অনুষ্ঠানে একটা গল্প বলেছিলেন।
গল্পটিতে তিনি ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় রাশিয়ার একটি পরিবারের সর্বোচ্চ ত্যাগের কথা তুলে ধরেন। সে পরিবারে ছিলো ৩ ছেলে আর তাদের মা। ঐ মা তার ৩ ছেলেকেই যুদ্ধে পাঠিয়েছেন। কিছুদিন পরে একটি কফিনে করে এক সন্তানের লাশ আসলো এবং ধর্মীয় রীতিতে তার সৎকার করা হলো। সৎকার শেষে গ্রামবাসী ঐ মহিলাকে অনুরোধ করেন যেন তার কবরের কাছে একটি গাছ লাগিয়ে দেয়া হয় যেটা ছেলেটার মৃত্যু এবং ঐ মহিলার সর্বোচ্চ ত্যাগের স্মৃতি যুগযুগ ধরে বহন করবে। কথা মতো মহিলা একটি গাছ লাগালেন এবং একে একে মহিলার বাকি দুইটি সন্তানও যুদ্ধে মৃত্যুবরণ করলেন এবং সবার ক্ষেত্রেই একটি করে গাছ লাগিয়ে দিলেন।
গল্প শেষে কৃষিবিষয়ক ঐ অনুষ্ঠানে মাননীয় সাবেক গভর্নর প্রস্তাব করলেন যে, আমরাও যদি সরকারীভাবে আমাদের ৩০ লক্ষ শহীদ ও ২ লক্ষ মা-বোনের ত্যাগের কথা স্মরণ করে প্রতিবছর ৩২ লক্ষ গাছ লাগাতে পারি তাহলে আমাদের দেশটা সবুজে সবুজে ভরে যাবে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ করার বিষয় হলো বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তন ও ফলশ্রুতিতে ক্রমশ পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় এখন দ্রুত হারে হিমালয়ের বরফ গলছে এবং দিনদিন সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে। জাতিসংঘের একটি বিজ্ঞানী প্যানেলের রিপোর্ট অনুযায়ী ২১০০ সাল নাগাদ সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা ১.১ মিটার পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে। যার ফলে পৃথিবীর নিম্নাঞ্চলে অবস্থিত দেশগুলো মারাত্মক হুমকির মুখে পড়বে।
ইতোমধ্যেই জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে পৃথিবীর উন্নত-অনুন্নত অনেক দেশেই বিভিন্ন প্রাকৃতিক দূর্যোগ যেমন: ঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, নদীভাঙ্গন, ভূমিধ্বসসহ ভূমিকম্প ও সুনামির আঘাত দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এছাড়া, সময়ে সময়ে বড় বড় ঘূর্ণিঝড় যেমন: সিডর, আইলা, নার্গিস, রেশমি, আম্পানতো লেগেই আছে। ছোট-বড় এসকল প্রাকৃতিক দূর্যোগের ফলে মানুষ ও অন্যান্য প্রানীকুলের জীবনচক্র ক্রমাগত হুমকির মুখে পড়ছে। পৃথিবীতে বাড়ছে খাদ্য সংকট, বাড়ছে উদ্বাস্তুর সংখ্যা যা অনেক ক্ষেত্রে সামাজিক ও মানবিক অবক্ষয়ের কারণ।
পৃথিবীর নিম্নাঞ্চল হিসেবে বাংলাদেশে ঝড়, বন্যা, খরাসহ সমুদ্রতীরবর্তী অঞ্চলে লবণাক্ততা বৃদ্ধি, ক্রমাগত নদী ভাঙ্গন ও ভূমিধ্বসের ফলে কমে যাচ্ছে কৃষি জমির পরিমাণ এবং ভেঙ্গে যাচ্ছে প্রাকৃতিক ভারসাম্য। যার ফলে ঐসকল অঞ্চলে বাড়ছে স্বাস্থ্য ঝুঁকি ও আক্রমন করছে নানা রোগব্যাধি। সম্প্রতি বৃষ্টির পানির সাথে উজানের পানি ও পাহাড়ি ঢলে দেশের উত্তরাঞ্চল ও পূর্বাঞ্চলের অনেক জেলা-ই প্লাবিত হয়েছে। যার ফলে তলিয়ে গেছে ঘর-বাড়ি, রাস্তাঘাট, কৃষিজমিসহ নানা শাক-সবজি ও ফসলের বীজতলা। প্রাকৃতিক এসব দূর্যোগ লেগেই থাকবে যদি রাষ্ট্রীয়ভাবে বৃহৎ পরিসরে তা সমাধানের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ না করা হয়।
আশার বিষয় হচ্ছে,“মুজিববর্ষ” উপলক্ষে গত ১৬ জুলাই, ২০২০ তারিখে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ১ কোটি চারা গাছ রোপন করার কর্মসূচী উদ্ভোধন করেছেন। এ কর্মসূচী বাস্তবায়নের জন্য পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রনালয়কে সময়সীমা বেধেঁ দেয়া হয়েছে ১৬ জুলাই থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। এ কর্মসূচীর আওতায় দেশের মোট ৪৯২ টি উপজেলার প্রতিটিতে ২০ হাজার ৩২৫ টি করে চারাগাছ রোপণের সিদ্ধানÍ গৃহিত হয়েছে। দেশীয় বনজ, ফলদ ও ঔষধি গাছের চারা রোপনের এ কর্মসূচীর ৫০% অর্থাৎ অর্ধেকই থাকবে ফলদ গাছ; যাতে করে ভবিষ্যতে দেশীয় চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি বিদেশে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা যায়।
সরকারের এ বৃহৎ কর্মসূচী যদি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা যায় এবং সাবেক গভর্নর ড.আতিউর রহমান স্যারের প্রস্তাব অনুযায়ী এ ধরণের কর্মসূচী যদি প্রতিবছরই চলমান থাকে তাহলে পুরো বিশ্বের জলবায়ু সংকট না ঠেকাতে পারলেও ভবিষ্যতে অন্তত নিজ দেশকে বড় ধরণের প্রাকৃতিক দূর্যোগের হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব হতে পারে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বাসযোগ্য বাংলাদেশ বিনির্মান করা সম্ভব হবে।
এ ধরণের কর্মসূচী বাস্তবায়নের জন্য দরকার সরকারের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা আর সাধারণ জনগনের দেশপ্রেমের সেতুবন্ধন। বর্তমানে বাংলাদেশ Demographic Dividend এর সুফল ভোগ করছে অর্থাৎ দেশের প্রায় ৬৫% এর উপরে কর্মক্ষম জনগণ রয়েছে যাদের বয়স ১৪-৬৪ বছর। দেশের স্থানীয় সরকার যেমন: জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ এবং ইউনিয়ন পরিষদের সরকারী কর্মকর্তাগণ এ ধরণের মহৎ ও বৃহৎ কর্মযজ্ঞে স্থানীয় দক্ষ যুব সমাজকে কাজে লাগাতে পারে। তাহলেই একদিন হয়তো আমাদের এ দেশটা গ্রীণ বাংলাদেশ নামে বিশ্ববাসীর কাছে পরিচিত হয়ে উঠবে এবং অন্যান্য দেশের কাছে রোল মডেল হিসেবে আবির্ভূত হবে। পরিশেষে ডাচ বাংলা ব্যাংকের একটি বিজ্ঞাপনের উদ্ধৃতি দিয়ে শেষ করতে চাই:
“মানুষ বাঁচে আশায়
দেশ বাঁচে ভালোবাসায়”